Sapiens এর জনপ্রিয় লেখক ইউভাল নোয়া হারারি বলেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI মানব সভ্যতার অপারেটিং সিস্টেম হ্যাক করেছে - ২০২৩ অনুবাদ

ইউভাল হারারি

ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক ইউভাল বলেন গল্প-বলা কম্পিউটার মানব ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করে দেবে

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা:

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা Artificial Intelligence (AI)  এর ভীতি কম্পিউটার যুগের শুরু থেকেই মানবতাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এখন পর্যন্ত এই ভয় যন্ত্র ব্যবহার করে বস্তুগত উপায়ে মানুষকে হত্যা, দাসত্ব বা মানুষের অবস্থান প্রতিস্থাপনের উপর দৃষ্টিপাত করা। তবে গত কয়েক বছরে এমন সব নতুন AI যন্ত্রপাতির আবির্ভাব ঘটেছে যা মানব সভ্যতার ঠিকে থাকাকে অপ্রত্যাশিত দিক থেকে হুমকির মুখে ফেলেছে দিয়েছে। শব্দ দ্বারা হোক বা হোক চিত্র দিয়ে বা ধ্বনি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভাষা ব্যবহার এবং উৎপাদনের কিছু অসাধারণ ক্ষমতা অর্জন করেছে। তাই বলায় যায় যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের সভ্যতার অপারেটিং সিস্টেম বা কর্ম পদ্ধতি হ্যাক করেছে।

ভাষা এমন এক উপাদান যা দিয়ে প্রায় সমস্ত মানব সংস্কৃতির সূচনা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, মানবাধিকার আমাদের DNA তে খোদাই করা নেই। বরং, তা হলো কিছু সাংস্কৃতিক নিদর্শন যা আমরা গল্প বলা এবং আইন লিখে তৈরি করেছি। পৃথিবীর ঈশ্বর সমূহ কোনো বস্তুগত বাস্তবতা নয়। বরং, তা হলো সাংস্কৃতিক নিদর্শন যা আমরা পৌরাণিক কল্প-কথার উদ্ভাবন এবং ধর্মগ্রন্থ রচনা করে তৈরি করেছি।

অর্থও একটি সাংস্কৃতিক নিদর্শন। ব্যাঙ্কনোটগুলি কেবল কাগজের রঙিন টুকরো, আর বর্তমান সময়ে ৯০% নোটই কিন্তু ব্যাংকনোট নয়— তা কেবলই কম্পিউটারে সংরক্ষিত ডিজিটাল তথ্য। টাকা বা অর্থকে যে জিনিসটি মূল্যবান করে তোলে তা হল অর্থ সম্পর্কে ব্যাংকার, অর্থমন্ত্রী এবং ক্রিপ্টোকারেন্সি গুরুদের বলা কাহিনি। যদিও আমেরিকান উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারী স্যাম ব্যাঙ্কম্যান-ফ্রাইড,উদ্যোক্তা আমেরিকান বায়ুটেকনোলজি উদ্যোক্তা  এলিজাবেথ হোমস ও আমেরকিান পুঁজিপতি বার্নি ম্যাডফ‘রা প্রকৃত মূল্য তৈরিতে তেমন ভালো না হলেও তারা সকলেই অত্যন্ত দক্ষ গল্পকার ছিলেন।

গল্প বলা, সঙ্গীত রচনা করা, ছবি আঁকা এবং আইন ও ধর্মগ্রন্থ লেখার ক্ষেত্রে এক অ-মানবীয় বুদ্ধিমত্তা গড় মানুষের চেয়ে ভালো বা কার্যকর হয়ে উঠলে কী হবে? মানুষ যখন ChatGPT’র মতো আরও অন্যসব নতুন নতুন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপকরণ সম্পর্কে আলোচনা করছে, তখন তারা অধিকাংশ সময় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপকরণ ব্যবহার করে স্কুল শিশুদের প্রবন্ধ লিখার মতো উদাহরণ ‍নিয়ে চিন্তা করে ।

বাচ্চারা যদি তা করে তখন স্কুল পরিচালনা পদ্ধতি বা স্কুল কার্যক্রমের কি হবে? কিন্তু এই ধরনের প্রশ্ন বড় চিত্রকে পাশ কাটিয়ে যায়। শিশুদের স্কুলের প্রবন্ধ লিখার কথা ভুলে যান (মানুষ এক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা কয়েক মিনিটের মধ্যে একটি বই লিখতে পারবে)। ২০২৪ সালে আমেরিকার পরবর্তী রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচনের কথা ভাবুন এবং আর এর প্রভাব কল্পনা করার চেষ্টা করুন। রাজনৈতিক বিষয়বস্তু, ভুয়া সংবাদ তৈরিতে এবং কাল্ট জাতীয় নতুন ধর্ম প্রণয়নে ধর্মগ্রন্থ উৎপাদনের ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে কল্পনা করুন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে  QAnon একটি ধর্মীয় কাল্ট (ইংরেজি শব্দ cult এর প্রাথমিক অর্থ হলো কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি নির্দেশিত ধর্মীয় উপাসনা বা সম্মানের প্রক্রিয়া) অনলাইন ভিত্তিক বেনামি Q drops নামক বার্তাকে ঘিরে কেন্দ্রিভূত হয়েছে।  এর অনুসারীরা Q drops থেকে বার্তা সংগ্রহ করছে, সম্মান করছে এবং এর বার্তাকে ধর্মীয় পাঠ্য হিসেবে পবিত্র বলে ব্যাখ্যা করছে। যেখানে আমাদের জানা মতে পূর্বে  Q drop ‘র বার্তাগুলি মানুষের দ্বারা লেখা হতো আর বট সেগুলিকে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করতো, সেখানে ভবিষ্যতে আমরা ইতিহাসের প্রথমবার অ-মানব বুদ্ধিমত্তা দ্বারা ধর্মীয় পাঠ্য রচিত হওয়া মাধ্যমে কোনো কাল্ট দেখতে পাব। ইতিহাস জুড়ে পরিলক্ষিত হয় যে সকল ধর্মের পবিত্র গ্রন্থগুলি কোনো অ-মানবীয় সত্তা দ্বারা রচিত বলে দাবি করা হয়। কিন্তু শীঘ্রই তা বাস্তবে রূপ নিতে পারে।

আরও সহজবোধ্যভাবে বলতে গেলে, আমরা শীঘ্রই নিজেরা গর্ভপাত, জলবায়ু পরিবর্তন বা ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিষয়ে যাদেরকে আমরা মানুষ মনে করি তাদের সাথে অনলাইনে দীর্ঘ আলোচনা করব–কিন্তু তারা প্রকৃত পক্ষে মানুষ নয়, AI বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। কিন্তু সমস্যা হল, যেকোনো AI bot কর্তৃক ঘোষিত কোনো মতামত পরিবর্তন করার চেষ্টা করে সময় ব্যয় করাটা আমাদের জন্য একেবারেই অর্থহীন হয়ে উঠবে, কারণ AI এতই নিখুঁতভাবে তথ্য উপস্থাপন করতে পারে যে তা দ্বারা নিজেদের প্রভাবিত করার একটি ভাল সুযোগ রয়েছে।

ভাষার দক্ষতার মাধ্যমে, AI এমনকি মানুষের সাথেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করতে পারে আর এই ঘনিষ্ঠতার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের মতামত এবং বিশ্ববীক্ষা বা Worldview পরিবর্তন করাতে পারে। যদিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তার নিজস্ব কোনো চেতনা বা অনুভূতি আছে কিনা তার তেমন কোনো ইঙ্গিত নেই, তবে, মানুষের সাথে কৃত্রিম ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষকে মানসিক বা  আবেগগতভাবে এর সাথে সম্পৃক্ত করাতে পারাটাই এর জন্য যথেষ্ট।

ব্লেইক লেমোইন নামের একজন গুগল প্রকৌশলী ২০২২ সালের জুনে প্রকাশ্যে দাবি করেছিলেন যে LaMDA নামের AI chatbot টি, যার উপর তিনি কাজ করছিলেন, সংবেদনশীল হয়ে উঠেছিল। তার বিতর্কিত দাবির কারণে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। এই ঘটনার সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়টি কিন্তু লেমোইনের দাবিটি নয়, যা সম্ভবত মিথ্যা ছিল, বরং, আকর্ষণীয় বিষয়টি ছিল তার LaMDA এর জন্য তিনি তার লোভনীয় চাকরি হারানোর ঝুঁকি নেওয়ার ইচ্ছাটি। AI যদি এর জন্য মানুষকে তাদের চাকরির ঝুঁকি নেওয়ার মতো মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে, তবে তা তাদের আর কী কী করাতে প্রভাবিত করতে পারে?

মন এবং হৃদয়ের রাজনৈতিক যুদ্ধে ঘনিষ্ঠতা সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্র, আর  কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা লক্ষ লক্ষ মানুষের সাথে গণহারে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করার ক্ষমতা অর্জন করেছে। আমরা সকলেই জানি যে গত এক দশকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানুষের মনোযোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। নতুন প্রজন্মের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে যুদ্ধক্ষেত্র মনোযোগ থেকে ঘনিষ্ঠতার দিকে ধাবিত হচ্ছে।

আমাদের সাথে কৃত্রিম ঘনিষ্ঠতার জন্য যদি এক  কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অন্য এক  কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাথে যুদ্ধ করে বিশেষ কোনো রাজনীতিবিদকে ভোট দেওয়ার জন্য বা বিশেষ কোনো পণ্য ক্রয়ের জন্য আমাদের বোঝাতে পারে তখন মানব সমাজ ও মানুষের মানসিক প্রকৃতির কী হবে?

এমনকি “কৃত্রিম ঘনিষ্ঠতা” তৈরি না করেও, নতুন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উপকরণ আমাদের মতামত এবং বিশ্ববীক্ষা বা Worldview’র উপর একটি বিশাল প্রভাব ফেলবে। মানুষ কোনো একক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উপদেষ্টাকে সবজান্তা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ব্যক্তি হিসেবে  ব্যবহার করতে পারে। গুগল যে এই বিষয়ে আতঙ্কিত, তাতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। কেনই বা গুগলেই আমি সার্চ করতে যাব যখন আমি কেবল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো ভবিষ্যৎদ্রষ্টার কাছে জিজ্ঞেস করতে পারি? খবর এবং বিজ্ঞাপন শিল্পেরও আতঙ্কিত হওয়ার কারণ রয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে প্রশ্ন করলেই যেখানে আমি সর্বশেষ সংবাদ পাচ্ছি সেখানে আমি  কেনই বা সংবাদপত্র পড়তে যাবো? বিজ্ঞাপনেরই বা উদ্দেশ্য কী, যখন আমি কি কিনব তা কেবল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাছ থেকে জেনে নিতে পারি?

এবং তারপরও এই ঘটনা সমূহ সত্যিকারের বৃহৎ চিত্রকে ধারণ করে না। আমরা যে বিষয়ের ব্যাপারে কথা বলছি তা হল সম্ভাবনীয়রূপে মানব ইতিহাসের সম্ভাব্য সমাপ্তি। ইতিহাসের সমাপ্তি নয়, বরং মানব-অধ্যুষিত ইতিহাস অংশের সমাপ্তি। ইতিহাস হল জীববিজ্ঞান এবং সংস্কৃতির, আমাদের জৈবিক চাহিদা এবং খাদ্য এবং যৌনতার মতো বস্তুর জন্য বাসনা ও ধর্ম এবং আইনের মতো আমাদের সাংস্কৃতিক সৃষ্টির মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। ইতিহাস হল এমন এক প্রক্রিয়া যা আইন ও ধর্ম খাদ্য আর যৌনতাকে রূপ দেয়।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি আমাদের সংস্কৃতি দখল করে, গল্প, সঙ্গীত, আইনকানুন আর ধর্ম উৎপন্ন শুরু করে দেয় তখন ইতিহাসের গতিপথের কখন কী হবে ? মুদ্রণযন্ত্র এবং রেডিওর মতো অতীতে সরঞ্জাম সমূহ মানুষের সাংস্কৃতিক ধারণাকে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছিল, কিন্তু তারা কখনই তাদের নিজস্ব নতুন সাংস্কৃতিক ধারণা তৈরি করেনি। সেক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একেবারেই ভিন্ন।কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পূর্ণ নতুন ধারণা, সম্পূর্ণ নতুন সংস্কৃতি তৈরি করতে সমর্থ।

প্রথম দিকে,কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্ভবত মানবীয় আদিরূপ অনুকরণ করবে যেভাবে তাকে তার সূচনাকালে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। হয়েছিল। কিন্তু প্রতিটা বছর অতিক্রম হওয়ার  সাথে সাথে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সংস্কৃতি দর্পের সাথে এমন সব স্থানে পদার্পণ করবে  যেখানে আগে কোনও মানুষ যায়নি। হাজার বছর ধরে মানুষ অন্য মানুষের স্বপ্নের ভিতর বাস করেছে। কিন্তু আগামী কয়েক দশকে আমরা হয়তো নিজেদেরকে বহিরাগত বুদ্ধিমত্তার স্বপ্নের মধ্যে বাস করতে যাব।

মাত্র বিগত কয়েক দশক ধরে মানবজাতিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভীতি তাড়িত করেছে। কিন্তু হাজার হাজার বছর ধরে মানবজাতি এক আরও গভীর ভয়ে তাড়িত হচ্ছে। আমরা সবসময় আমাদের মনকে চালিত করতে ও ভ্রম/ বিভ্রম তৈরি করার জন্য গল্প এবং চিত্রের শক্তির প্রশংসা করেছি। ফলশ্রুতিতে, প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ বিভ্রমের জগতে আটকে পড়াকে ভয় করেছে।

১৭ শতকে রেনে ডেকার্ট ভয় পেয়েছিলেন যে তাকে সম্ভবত কোনো এক বিদ্বেষপূর্ণ দানব তিনি যা দেখেছেন ও শুনেছেন সবকিছু সৃষ্টি করে বিভ্রমের জগতে আটকে রেখেছে। প্রাচীন গ্রীসে দার্শনিক প্লেটো বিখ্যাত গুহার রুপক বর্ণনা বা Allegory of the Cave’র কথা বলেছিলেন যেখানে একদল লোক একটি গুহার ভিতরে সারাজীবন  এক ফাঁকা প্রাচীরের মুখোমুখি হয়ে শিকলে বন্দী থাকে। প্রাচীরটি ছিল একটি পর্দা, যেখানে তারা প্রতিফলিত বিভিন্ন ছায়া দেখতে পেত। বন্দিরা সেখানে দেখতে পাওয়া বিভ্রমকে বাস্তবতা ধরে নিয়ে বলে ভুল করতো।

প্রাচীন ভারতে বৌদ্ধ এবং হিন্দু ঋষিরা বুঝতে পেরেছিলেন যে সমস্ত মানুষ মায়া’র বা বিভ্রমের জগতে বন্দিদশায় বাস করেছে। যাকে আমরা সাধারণত সত্য/বাস্তব হিসাবে গ্রহণ করি তা অনেক সময় আমাদের নিজের মনের কল্পনা মাত্র। এই কল্পনা বা বিভ্রমের উপর বিশ্বাসের কারণে অন্যকে হত্যা করে এবং নিজেদেরকে জলাঞ্জলি দেওয়ার ইচ্ছায় মানুষ সম্পূর্ণ যুদ্ধ চালাতে পারে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিপ্লব আমাদের ডেকার্ট দানবের, প্লেটোর গুহা ও মায়া’র মুখোমুখি করাচ্ছে। আমরা যদি সতর্ক না হই, তাহলে আমরা হয়তো বিভ্রমের পর্দার আড়ালে আটকা পড়ে যাবো, যে পর্দা আমরা ছিঁড়ে ফেলতে পারব না—অথবা উপলব্ধিও করতে পারব না যে এমন কোনো পর্দার অস্তিত্ব রয়েছে।

অবশ্য,কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শক্তিকে ভাল উদ্দেশ্যেও ব্যবহার করা যেতে পারে। আমি এটা নিয়ে পড়ে থাকব না, কারণ যারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ করছে তারা এর উন্নয়ন বিকাশ সম্পর্কে যথেষ্ট কথা বলেন। আমার মতো ইতিহাসবিদ ও দার্শনিকদের কাজই হলো বিপজ্জনক দিনগুলি তুলে ধরা। তবে অবশ্যই,কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ক্যান্সারের নতুন নিরাময় সন্ধান থেকে শুরু করে পরিবেশগত সংকটের সমাধান আবিষ্কার পর্যন্ত অসংখ্য উপায়ে আমাদের সাহায্য করতে পারে। আজকাল আমরা যে প্রশ্নটির মুখোমুখি হই তা হল কীভাবে অপব্যবহারের বদলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উপকরণকে ভালোর জন্য ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। আর তা করতে হলে, আমাদের প্রথমে এইসব উপকরণের প্রকৃত ক্ষমতা উপলব্ধি করতে হবে।

১৯৪৫ সাল থেকে আমরা জানি যে পারমাণবিক প্রযুক্তি মানুষের সুবিধার জন্য সহজলভ্য শক্তি উৎপন্ন করতে পারে–কিন্তু শারীরিকভাবে তা মানব সভ্যতাকেও ধ্বংস করতে পারে। তাই আমরা মানবতাকে সুরক্ষার জন্য এবং পারমাণবিক প্রযুক্তিকে অগ্রণীভাবে মানুষের কল্যাণের জন্য ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য সমগ্র আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে পুনর্নির্মাণ করেছি। এখন আমাদের মানসিক এবং সামাজিক জগতকে ধ্বংস করতে পারে এমন এক নব গণবিধ্বংসী অস্ত্রের সাথে লড়তে হবে আমাদের।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উপকরণকে আমরা এখনও নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তবে আমাদের উচিত তা দ্রুত করা। কারণ পারমাণবিক অস্ত্র আরও শক্তিশালী পারমাণবিক অস্ত্র আবিষ্কার করতে না পারলেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আরও শক্তিশালী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করতে সক্ষম। প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপটি হবে কোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উপকরণকে পাবলিক ডোমেইনে প্রকাশ করার পূর্বে  কঠোর নিরাপত্তামূলক পরীক্ষানিরীক্ষার দাবি জানানো।

ঠিক যেমনটি কোনো ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি নতুন কোনো ওষুধ বাজারে ছাড়ার  পূর্বে এর স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পরীক্ষানিরীক্ষা করে, ঠিক তেমনি নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে কোনো প্রযুক্তি কোম্পানির উচিত নয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উপকরণ প্রকাশ করা। এই নতুন প্রযুক্তির জন্য আমাদের খাদ্য ও ওষুধের প্রশাসনে সমতুল্য একটি প্রশাসন প্রয়োজন , আর গতকালই এর প্রয়োজন ছিল।

তাহলে জনগণের কাছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিস্তারের গতিরোধ কি গণতন্ত্রের জন্য অধিকতর নির্মম স্বৈরাচারী শাসন থেকে পিছিয়ে থাকার কারণ হবে না ? ঠিক তার উল্টোটাই হবে। অনিয়ন্ত্রিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিস্তার সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে, যা স্বৈরাচারী শাসকদের উপকার করবে আর গণতন্ত্রকে করবে ধ্বংস। গণতন্ত্র হল আলোচনার, আর সেই আলোচনা নির্ভর করে ভাষার উপর। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যখন আমাদের ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করে তখন তা আমাদের অর্থবহ আলোচনার সামর্থ্যকে ধ্বংস করতে পারে, তাতে করে ধ্বংস করতে পারে গণতন্ত্র।

আমরা সবেমাত্র এই গ্রহে এক বহিরাগত বুদ্ধিমত্তার সম্মুখীন হয়েছি। এটি যে আমাদের সভ্যতাকে ধ্বংস করতে পারে তা ছাড়া আমরা এটি সম্পর্কে অনেক কিছু জানি না। গণ পরিসরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উপকরণের দায়িত্বজ্ঞানহীন বিস্তার আমাদের বন্ধ করা উচিত, আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের নিয়ন্ত্রণ করার আগে আমাদের উচিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করা। এবং এর নিয়ন্ত্রণের জন্য আমি প্রথমে যে নিয়মটি আমি প্রস্তাব করতে পারি তা হলো বাধ্যতামূলকভাবে যেন AI প্রকাশ করে যে এটি AI। আমি যখন কারো সাথে কথোপকথন করি তখন যদি আমি বুঝতে না পারি আমি কোনো মানুষ, না কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাথে কথোপকথন করছি , আমার মতে সেটাই হবে গণতন্ত্রের সমাপ্তি।


প্রবন্ধটি ব্রিটিশ প্রভাবশালী সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন The Economist এর Yuval Noah Harari argues that AI has hacked the operating system of human civilisation থেকে অনুরুপ অনুদিত। প্রবন্ধটি গত এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয়।

ইউভাল নোয়া হারারি একজন ইতিহাসবিদ, দার্শনিক এবং “Sapiens”, “Homo Deus” এবং শিশু সিরিজ “Unstoppable Us” এর লেখক। তিনি হিব্রু ইউনিভার্সিটি অফ জেরুজালেমের ইতিহাস বিভাগের একজন প্রভাষক এবং সামাজিক-প্রভাব কোম্পানি Sapienship সহ-প্রতিষ্ঠাতা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন