প্রকৃতি ও বিজ্ঞান: মানুষের কল্যাণে জরুরী উন্নয়ন না সংরক্ষণ
প্রকৃতি ও বিজ্ঞান আর মানুষের বিনাশ সম্ভবত কাছাকাছি সম্পৃক্ত। একদিন যদি মানুষকে বিলুপ্ত হতে হয় তাহলে প্রাথমিকভাবে তার জন্য দায়ী থাকবে বিজ্ঞান। পৃথিবীর প্রায় সব মানুষের কাছে পৌঁছে বিজ্ঞান অসংখ্যভাবে মানুষ সাহায্য করছে। বিজ্ঞান বিরামহীন উন্নতির ঘটনাও মানুষের দুর্বলতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছ।
আমরা বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত বিকাশের স্বার্থে প্রকৃতি ধ্বংস করছি যাতে মনুষ্যনির্মিত এবং কৃত্রিমকে লালন করা যায়। আমরা কেবল দূষিত খাবার গ্রহণের জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে শস্য উৎপাদন করছি। আমরা প্রাকৃতিক সবকিছুকে হত্যা করছি যেন কৃত্রিমগুলিই আমাদের মুক্তি। অপ্রাকৃত এবং ধ্বংসাত্মক যে কোনও কিছুর উপর নির্ভরতা বাড়িয়ে আমরা নিজেকে স্বাধীন করে তুলছি।
প্রকৃতি ও বিজ্ঞান
যদি একদিন মানুষ বিলুপ্ত হয়, তবে বিজ্ঞানই এর প্রাথমিক কারণ হবে কারণ এটি প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক সব কিছুর উপর প্রশ্ন বোধক চিহ্ন এঁটে দিয়েছে। বস্তুত, সব ধরণের দূষণ চূড়ান্তভাবে বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত। বিজ্ঞান এবং মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্যতা এবং মানুষের মাঝে এর বেপরোয়া গ্রহণযোগ্যতা একটি অনিবার্য ভিত্তির প্রবর্তন করছে : বিজ্ঞান এবং মানুষের ধ্বংস। প্রকৃতি মানুষের মানসিক এবং শারীরিক সুস্থতার জন্য চিকিৎসা হিসাবে কাজ করে। প্রকৃতি আমাদের নিরাময় করে।
প্রকৃতি আমাদের সরবরাহ করে। এবং প্রয়োজনীয়তা অনুসারে প্রকৃতি বিনাশের মাধ্যমে এর আইন বজায় রাখে। একদিন খুব কাছাকাছি যখন প্রকৃতি আমাদের আর যত্ন এবং নিরাময় এবং আর পরিষ্কার করবে না কংক্রিট এবং প্রযুক্তিগত কাঠামোতে মানুষের বিশাল অগ্রগতির কারণে।
সম্প্রতি আমি কেবল কয়েকটি পর্যটন আকর্ষণ নয়, বরং এমন জায়গায়ও ভ্রমণ করেছি যেখানে নগর জীবন-যাত্রা এখনও একটি দূর স্বপ্ন। আর ক্রমবর্ধমান বিজ্ঞান এবং অবকাঠামোগত বিকাশ একদিন এই আদিম, অকলুষিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আক্রমণ করবে জানতে পারাটা আমাকে চূড়ান্তভাবে যন্ত্রণা দেয়।
বাংলাদেশের প্রকৃতি
গত কয়েক মাস ছিল বিরক্তিকর। নগরীর জীবনযাপন প্রতিদিন বিভিন্ন ধরণের দূষণের কারণে অসুস্থ হয়ে উঠছে। আমি কোথাও ঘুরে দেখার অপেক্ষায় ছিলাম, যা শহর থেকে দূরে যে কোনও জায়গায় হতে পারে। আমার কিছুটা স্বাস্থ্যকর বাতাসের অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল, জীবনযাপন যেখানে কম জনাকীর্ণ আর স্থূল সেখানে নিজেকে এলিয়ে দিতে চাই।
কিছু ভ্রমণ পিয়াসু বন্ধুদের পেয়ে , গত আমরা ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৯ এ কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া, মহেশখালী এবং সোনাদিয়া দ্বীপপুঞ্জ ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত পাকাপোক্ত করি। চট্টগ্রাম শহর থেকে পাঁচ ঘণ্টারও অধিক দীর্ঘ বাস এবং লঞ্চ-বোট যাত্রা শেষে রাত ৮ টার দিকে আমরা কুতুবদিয়া দ্বীপে পৌঁছে যায়। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠা ছিল অসাধারণ। শীতের হালকা কুয়াশা, বিনয়ী অথচ শালীন ঘরবাড়ি, সদ্য কাটা ফসলের অবিরাম জমি, সবকিছুই উদীয়মান সূর্যের সোনালী রশ্মিতে স্নাত।
কাঁচা রাস্তার দুপাশে লবণের মাঠ, আর গুচ্ছ পরিবারের সম্প্রদায়ে বাস করার দৃশ্যকে মতো ছবির মনে হয়। সাধারণ জীবনযাত্রা এবং স্থানীয়দের নিরপেক্ষ আন্তরিকতা ছিল সবদিকে তুলনাহীন। মালিক শাহ হুজুরের সুফি দরবার, বাতি ঘর, বায়ু বিদ্যুৎ টারবাইন ও সুন্দর সমুদ্র সৈকত হলো এই দ্বীপের বেশ কয়েকটি আকর্ষণীয় স্থানের কয়েকটি।দ্বীপের বেশ কয়েকটি সুন্দর জায়গায় ঘুরে দেখার পরে আমরা ২৬ ডিসেম্বর আরেকটি আরেকটি পাহাড়ি দ্বীপের দিকে যাত্রা করলাম: মহেশখালী। মুসলমান সহ, হিন্দু, খ্রিস্টান এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এই দ্বীপের জনসংখ্যা মোট আড়াই লাখের মতো, সাথে রয়েছে ২১০ টি মসজিদ, ২৬ টি হিন্দু মন্দির এবং ৬টি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ক্যায়াং ঘর।
দ্বীপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক আদিনাথ মন্দিরটি মৈনাক পাহাড়ে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮৫.৩ মিটার উপরে অবস্থিত। বৌদ্ধ স্বর্ণ মন্দির, মৈনাক পাহাড় এবং আদিনাথ মন্দির হলো কয়েকটি দর্শনীয় স্থান। আদিনাথ মন্দির, বৌদ্ধ স্বর্ণ মন্দির, মন্দির জেটি এবং গোরকঘাটা বোট-টার্মিনাল ঘুরে দেখার পরে আমরা আরও একটি সংলগ্ন দ্বীপ সোনাদিয়া ঘুরে দেখতে চাইলাম। দ্বীপটিতে মানুষের কোন স্থায়ী বাসিন্দা নেই। বাংলাদেশের ১৩টি Ecologically Critical Area অঞ্চলগুলির মধ্যে সোনাদিয়া অন্যতম একটি।
পরিবহনের কোনও উপায় না থাকায় আমরা বর্ধিত উঁচু-নিচু মাটির পথ দিয়ে পায়ে দ্বীপের দিকে যাত্রা শুরু করি। আমরা দুটি সেতু পেছনে রেখে প্রায় এক ঘণ্টা হাঁটলাম কিন্তু মানুষের কোনও চিহ্ন পেলাম না। দ্বীপটি এত বিচ্ছিন্ন আর বিস্তৃত ছিল যে দিনের আলোয় ফিরে যাওয়ার কোনও নিশ্চয়তা না থাকায় ভীত-সন্ত্রস্তে আমাদের ঠিক অর্ধেক পথ থেকে ফিরে আসতে হয়েছিল।
বন এবং নদী এই দ্বীপকে জড়িয়ে রেখেছে। পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের লোকেরা বিভিন্ন উপায়ে সম্পূর্ণরূপে দ্বীপটির উপর নির্ভরশীল। এটি দেখতে এত শান্তিপূর্ণ আর সুন্দর যে, যেখান থেকে আমরা ফিরে আসতে চাইনি সহজে। তবে এবং অর্থনৈতিক লোভ আর গভীর সমুদ্র-বন্দর নির্মাণের ভবিষ্যতের পরিকল্পনার দরুন একটি কথাই প্রতিধ্বনিত হবে: বিজ্ঞান এবং মানুষের বিনাশ।
পরের দিন আমরা কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভূমিতে পা রাখলাম। দু’দশক আগেও যখন আমি সেখানে প্রথমবারের মতো গিয়েছিলাম তখন স্থলপথে যাতায়াত ছিল এই অঞ্চলের মানুষের কাছে একটি দুঃস্বপ্ন, আজ সেখানে নগরায়ন আর কংক্রিটের বিকাশ কতটা দ্রুত রূপ নিয়েছে তা দেখে উচ্ছ্বসিত হয়েছি রীতিমত। এখন বাড়ির প্রায় প্রতিটি ছাদে রয়েছে সোলার প্যানেল, রয়েছে সর্বত্র বিদ্যুৎ, চলাফেরা জন্য রয়েছে ব্যাটারি চালিত টমটম, স্থান নিয়েছে বিশাল বিদেশী ড্রেজার সমূহ, আকাশ-চুম্বী ক্রেন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অবকাঠামো, আবাসিক হোটেল, উন্নতি চিকিৎসা সুবিধা এবং প্রতিদিনের অসাধারণ বাড়ন্ত আর্থিক প্রবাহ।
উন্নত যন্ত্রের আধিপত্যে যোগাযোগের পুরানো মাধ্যম, ইঞ্জিন চালিত নৌকা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে উন্নয়নের সকল সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়াই বেড়ে গেছে স্থানীয়দের দুঃখ-কষ্ট। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্পের জন্য অধিকৃত জমির অনেক মালিককে তাদের জমির যথাযথ মূল্য না পাওয়া আর যারা শেষ অবলম্বনটি হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতি দরুন প্রকল্পে চাকরি না হওয়াতে তা অনেকের জন্য যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আশেপাশের জমিতে মৌসুমি কৃষিকাজ কাজ করতেন এমন অনেকে তাদের জমি হারিয়েছেন। যে খাল আর জলাভূমি উপর স্থানীয়রা নির্ভরশীল ছিল,সংলগ্ন প্রকল্পের শক্তিশালী প্রভাবের কারণে এখন তা ভরাট আর অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। জেলেদের মাছ ধরার ক্ষেত্রগুলি প্রতিদিনই কমে যাচ্ছে। আর অনেকেই ভবিষ্যতে তাদের বাড়িঘর থেকে সম্ভাব্য উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার ভয়ে তাদের বাড়ি-ঘর পুনর্নির্মাণে আগ্রহী নয়।
পীড়াদায়ক পরিস্থিতি ও বিজ্ঞান আর মানুষের বিনাশ
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে কুতুবদিয়া, মহেশখালী এবং মাতারবাড়ী দ্বীপপুঞ্জের মানুষেরা ইতিমধ্যে মূল্য দিতে শুরু করেছে। নদী ও জলাশয় সমূহ ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। নদী- দূষণ আর ভাঙনের ফলে সৃষ্ট বিশাল পরিমাণের পলি কুতুবদিয়া-মহেশখালী চ্যানেলের অববাহিকায় বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চল তৈরি করেছে।
কক্সবাজার ও মহেশখালী বন্দরের টার্মিনাল জেটি প্রতিবছর সমুদ্রের আরও গভীর অংশে সরে যাচ্ছে। বঙ্গোপসাগরে জলজ প্রজাতির ক্রমবর্ধমান হ্রাসের দরুন মৎস্য সম্প্রদায়ের জীবন-জীবিকা হুমকিতে পড়েছে।
এই পরিবেশগত ঘটনাটি বহু লোককে তাদের গ্রামীণ বাড়ি ত্যাগ করে শহরে আশ্রয় গড়তে বাধ্য করার ফলে শহুরে জীবনযাত্রা প্রতি বছর আরও দুর্বিসহ। দ্রুত নগরায়ণ ও উন্নয়ন কার্যক্রম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে স্থানচ্যুতি আর গণ-অভিপ্রয়ন ব্যতীত আর কিছু বয়ে নিয়ে আসছে বলে আপাতত মনে হচ্ছেনা। এই উভয় কর্মপ্রয়াস দরিদ্র লোকদের মারাত্মক আঘাত করছে।
আবাদযোগ্য জমির আকার ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে, লবণ ক্ষেতের আয়তন কমে যাচ্ছে, জলাশয়গুলি আরও ছোট হয়ে পড়ছে, মাছের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে লক্ষণীয়ভাবে, আর কৃষক সম্প্রদায় আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষিতে।
মহেশখালী দ্বীপের মাতারবাড়িতে একটি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিকাশ পুরোদমে চলছে আর চলছে দুটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের কাজও। সরকারের বিদ্যুত-লোভী কর্মকান্ডে ফলে তাপ-বিকিরণ বৃদ্ধির কারণে মহেশখালী দ্বীপটি অদূর ভবিষ্যতে জনশুন্য ও অবাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারে।
“৩০ বছরের মধ্যে, আমরা এখানে আর বাস করতে পারব না”, বললেন দ্বীপের এক হতাশ বাসিন্দা। একথা অস্বীকার করার উপায় নাই যে, দ্বীপের জনগনের যোগাযোগ এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনা একরকম বেড়েছে। তা সত্ত্বেও এই অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকার হুমকির পরিমাণও বেড়েছে বহুগুণ ।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য মাতারবাড়িতে বিপুল পরিমাণ জমি দরকার হয়েছে। লবণ এবং মাছের চাষে নির্ভরশীল ছিল এমন অনেক লোক এখন অনিচ্ছাকৃতভাবে অন্য পেশায় ঝুঁকছেন। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্পের কারণে সমুদ্র-জলের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কৃষিকাজ পুরোপুরি সমুদ্রের জলের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় কৃষিকাজ নিদারুনভাবে ব্যহত হচ্ছে।
সোনাদিয়া দ্বীপে বিশাল ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার সোনাদিয়া দ্বীপে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে কাজ করছে। গভীর সমুদ্র বন্দরটি নির্মাণে জাপানি বিশেষজ্ঞরা কুতুবদিয়ার পরিবর্তে সোনাদিয়াকে বেশী উপযোগী দ্বীপ হিসেবে সন্ধান পেয়েছে, কারণ কুতুবদিয়ায় প্রতি বছর আশংকাজনকভাবে পলি জমে আর সেখান থেকে বিপুল সংখ্যক লোককে স্থানান্তরিত করার প্রয়োজন হতো ও অর্থনৈতিকভাবে হতো অনেক ব্যয়বহুল ।

শেষ করার জন্য আমাদের একই বিতর্কিত ভিত্তিটিতে ফিরে আসতে হবে: বৈজ্ঞানিক ঘটনা এবং মানব বিনাশ তাহলে কি অনিবার্য? প্রকৃতি আর প্রাকৃতিক ঘটনা প্রবাহ বিনাশ করে আমরা যদি কেবল অবকাঠামোগত আর প্রযুক্তিগত উৎকষের্র দিকে বেপরুয়াভাবে ধাবিত হয়ে থাকি তাহলে আমাদের বিনাশ অনিবার্য। কারণ আমরাই প্রকৃতি, প্রকৃতির অংশ। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি প্রকৃতির সাথে আমাদের প্রাকৃতির সেতুবন্ধনকে বিনাশ করতে ক্রমাগতভাবে।
যাইহোক, এই বিস্ময়কর দ্বীপপুঞ্জের দিকে আমাদের যাত্রা ছিল সত্যিই অর্থবহ এক ভ্রমণ। প্রকৃতি দেখুন। ভালবাসুন প্রকৃতিকে।